| |
               

মূল পাতা আরো জীবনযাপন দেশে কাসাভা উৎপাদন হচ্ছে, বাণিজ্যিক সম্ভাবনা কতটা?


বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন

দেশে কাসাভা উৎপাদন হচ্ছে, বাণিজ্যিক সম্ভাবনা কতটা?


রহমত নিউজ     04 September, 2023     12:35 PM    


বাংলাদেশের কুমিল্লা, নেত্রকোনা ও পার্বত্য অঞ্চল সহ কিছু এলাকায় কাসাভা নামক একটি ফসলের চাষ হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন খাদ্য হিসেবে খুব বড় বাজার তৈরির সম্ভাবনা কম থাকলেও শিল্পখাতে এর ব্যাপক ব্যবহারের সম্ভাবনায় ক্রমশ এর আবাদ বাড়ছে। তবে আবাদ বাড়লেও চাষ পদ্ধতি, জমির প্রকার এবং বাজার- এসব বিবেচনায় বাংলাদেশে কাসাভার ব্যাপক বানিজ্যিক চাষের সুযোগ কম বলেই বলছেন তারা। সরাসরি খাদ্য হিসেবে কাসাভার ব্যবহার বাংলাদেশে সীমিত হলেও গ্লুকোজ, বার্লি, সুজি কিংবা চিপসের মতো খাবার তৈরিতে এটি ব্যবহৃত হয়। তবে এর সবচেয়ে বড় ব্যবহারের জায়গা হলো শিল্প খাত।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোঃ সোলায়মান আলী ফকির বলছেন, খাদ্যের চেয়ে শিল্পে এর ব্যবহার হয় বেশি। বিশেষ করে বস্ত্র ও ঔষধ শিল্পের জন্য কাসাভা খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। গ্লুকোজের অন্যতম মূল উপাদান কাসাভা। এছাড়া বস্ত্র শিল্পে কাপড়ের মাড় তৈরিতে এটা দরকার। এজন্য বাংলাদেশকে এসব উপাদান এখন বহুলাংশেই আমদানি করতে হয়। সে কারণেই খাদ্যের চাইতে শিল্পের জন্য বাংলাদেশে কাসাভার ভবিষ্যত ভালো।

বাংলাদেশর কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডঃ মোঃ মনিরুল ইসলাম বলছেন, তারা ইতোমধ্যেই দুটি জাতের কাসাভার অনুমোদন দিয়েছেন। বাংলাদেশে এখন কাসাভা স্টার্চের (মাড় যা বস্ত্র ও ঔষধ শিল্পে ব্যবহার হয়) বার্ষিক চাহিদা প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টন। কিন্তু দেশে উৎপাদিত হয় ৫/৬ হাজার টন উৎপাদিত। আবার প্রতি বছর চাহিদা বাড়ছে দশ/পনের শতাংশ হারে।

তবে কৃষকরা কেউ কেউ বলছেন সব জমিতে ফসলটি হয় না আর কিছু বেসরকারি কোম্পানিই এখনো এর প্রধান ক্রেতা হওয়ায় অনেক সময় তারা ফসলটির যথাযথ মূল্য পান না। কুমিল্লার লালমাই এলাকার কাসাভা চাষি ইকবাল হোসেন বলেন, গত বছর প্রায় পনের একর জায়গায় কাসাভার চাষ করে ৫২ টনের মতো ফসল পেয়েছিলাম। কিন্তু সমস্যা হলো কোম্পানিগুলো যেভাবে দাম নির্ধারণ করে সেটাই মেনে নিতে হয়।

কাসাভা কী, এলো কোথা থেকে
কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন মিষ্টি আলু বা কচুর ওলের মতো কন্দাল জাতীয় এ ফসলটি বাংলাদেশে অনেকের কাছে শিমুল আলু হিসেবে পরিচিত। দেখতেও অনেক মাটির নীচের আলুর মতোই। এর চাষ পদ্ধতি তুলনামূলক সহজ এবং গাছ লাগানোর এক বছর পরই ফলন পাওয়া যায়। এর জন্য খুব বেশি পরিচর্যাও দরকার হয় না। উচ্চ ক্যালরিযুক্ত কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ কাসাভার পরিষ্কার টিউবার সরাসরি বা সেদ্ধ করে কিংবা কাঁচাও খাওয়া যায়। আবার এর থেকে আটা পাওয়া যায়, যা দিয়ে রুটি, বিস্কুটসহ বিভিন্ন খাবার তৈরি করা হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় ১০-১৫ বছর আগে এর চাষাবাদ লক্ষ্য করা যায়। রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, জামালপুর, মৌলভীবাজার, টাঙ্গাইল ও পঞ্চগড়সহ বিভিন্ন এলাকায় এটি চাষ হচ্ছে। সাধারণত নভেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত কাসাভা সংগ্রহ ও রোপণ দুটোই একসাথে হয়। কৃষকরা কাসাভার ফসল তোলার পরপরই এর বীজ রোপণ করে। বাংলাদেশে সীমিত হলেও আফ্রিকার প্রায় ৮০ কোটি মানুষের প্রধান একটি খাদ্য এই কাসাভা। ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় অনেকের কাছে এটি খাবার হিসেবে জনপ্রিয়।

দীর্ঘদিন ধরে কাসাভা নিয়ে গবেষণা করেছেন ড. মোঃ সোলায়মান আলী ফকির। তিনি বলেন, কাসাভা চাষের জন্য কিছুটা উঁচু জমি দরকার হয়। ফলে এর জায়গা কিছুটা সীমিত। পতিত জায়গা, বাড়ির উঠোন বা পাহাড়ি এলাকায় এর চাষাবাদ হতে পারে। টাঙ্গাইলের মধুপুর ও অন্য পার্বত্য অঞ্চলে এটি আগে থেকেই ছিলও খাবার হিসেবে। অতিথি আপ্যায়নেও পাহাড়িরা এটি ব্যবহার করে থাকে। খুব অল্প খরচে এটি উৎপাদন করা যায়। একটা গাছে বিশ কেজি পর্যন্ত কাসাভা আমি নিজেই পেয়েছি।

কী কাজে লাগে এই কাসাভা
সার্বিকভাবে খাদ্যের চাইতে শিল্পে কাসাভার ব্যবহার বেশি। বস্ত্র শিল্পে কাপড়ের মাড় তৈরিতে এটা দরকার হয়। কাগজ শিল্পেও ব্যবহৃত হয়। বিশ্বজুড়ে অবশ্য পশু খাদ্য, মানুষের খাদ্য, বস্ত্র আর ঔষধ শিল্পে এর ব্যবহার ব্যাপক। কাসাভা সংগ্রহের পর প্রক্রিয়াজাত করে স্টার্চ তৈরি করা হয়। এই স্টার্চ থেকেই গ্লুকোজ, বার্লি, সুজি, রুটিসহ বিভিন্ন ধরণের খাদ্য তৈরি করা যায়। বস্ত্র ও ওষুধ শিল্পে ব্যাপকভাবে কাসাভার স্টার্চ ব্যবহৃত হয়। ক্যাপসুলের কোটিং ও কিছু সিরাপ তৈরির জন্যও কাসাভা অপরিহার্য। জানা গেছে, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি কাসাভা উৎপাদিত হয় নাইজেরিয়ায় এবং সবচেয়ে বেশি রপ্তানি করে থাইল্যান্ড। আবার ভারতেও এর উৎপাদন অনেক। ফলে সেখানে গড়ে উঠেছে কাসাভা প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প।

ড. মনিরুল ইসলাম বলছেন, বস্ত্র শিল্পে কাপড়ে যে মাড় ব্যবহার করা হয় তা তৈরি হয় কাসাভা প্রক্রিয়াজাত করেই। ফলে বাংলাদেশকে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ স্টার্চ আমদানি করতে হয়।

বেসরকারি কোম্পানির বিনিয়োগ এবং এনজিওর সহায়তা
কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা মোঃ জোনায়েদ কবির খান বলছেন, লালমাই পাহাড় এলাকায় অনেক চাষিই বেসরকারি কোম্পানিগুলোর সহায়তা নিয়ে কাসাভা চাষ করছেন। বেসরকারি কিছু কোম্পানি এখানে বিনিয়োগ করেছে। আমরাও সাধ্যমত কৃষকদের সহায়তার চেষ্টা করছি।

বাংলাদেশের একটি সুপরিচিত বেসরকারি কোম্পানি ২০১৮ সালে ছয় হাজার একর জমির মধ্যে ৩০ হাজার টন কাসাভা উৎপাদন করেছে। তার আগের বছরেও তারা ১৪ হাজার টন কাসাভা উৎপাদন করেছিল দেশের বিভিন্ন জায়গায়। আবার চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলায় কাসাভা চাষে কৃষকদের সহায়তা দিচ্ছে বারসিক নামক একটি এনজিও।

সংস্থার আঞ্চলিক সমন্বয়কারী মোঃ শহীদুল ইসলাম বলছেন, ওই এলাকায় এখন ৭০ জনের মতো কৃষক কাসাভা চাষ করছেন এবং তারা বিভিন্ন জাতের কাসাভা কৃষকদের মধ্যে সরবরাহ করেছেন। এই এলাকাটি কিছুটা খরা প্রবণ। আর আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি যে খরার মধ্যে কাসাভা ভালো হয়। মূলত খরার কারণে যেন খাদ্যের অভাব না হয় সেজন্য এটি কৃষকদের দিচ্ছি আমরা। এখন আগে তারা দেখুক ও বুঝুক ফসলটি কেমন হয়। আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। কাসাভা গাছ গরু ছাগল বা গবাদি পশু না খাবার কারণে এটি জমি আইলেও চাষ করা সম্ভব। আবার বাড়িতে পরিত্যক্ত বা অনাবাদী জমিতেও চাষ করা যায়। কাসাভার তরকারি ছাড়াও এটি পাউডার করে রুটিসহ নানা ধরনের মজাদার রেসিপি তৈরি করা যায়।

কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, পাহাড়ি, টিলা কিংবা শুষ্ক এলাকাগুলোর যেখানে অন্য ফসল চাষ করা কঠিন সেখানেই কাসাভা ভালো চাষাবাদ হতে পারে। দেশের এমন জায়গাগুলো চিহ্নিত করে কাসাভা চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে পারলে এর ওপর আমদানি নির্ভরতা অনেকাংশেই কমানো সম্ভব।