| |
               

মূল পাতা আরো তথ্য প্রযুক্তি মোবাইল ফোনে চালু হচ্ছে জিও লোকেশন, এ প্রযুক্তি কিভাবে কাজ করে?


মোবাইল ফোনে চালু হচ্ছে জিও লোকেশন, এ প্রযুক্তি কিভাবে কাজ করে?


আন্তর্জাতিক ডেস্ক     21 October, 2023     09:58 AM    


আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে হঠাৎ করেই আলোচনায় এসেছে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে মানুষের জিও লোকেশন বা অবস্থান শনাক্ত করার প্রযুক্তি, যা আগামী মাস থেকেই মোবাইল অপারেটরদের মাধ্যমে কার্যকর হওয়ার কথা। এটি চালু হলে অপারেটরদের সহায়তা নিয়ে কিংবা সহায়তা ছাড়াই একজন বা এক সঙ্গে অনেক মানুষের সুনির্দিষ্ট অবস্থান শনাক্ত করতে পারবে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী বা নজরদারির সঙ্গে জড়িত সংস্থাগুলো। অর্থাৎ লোকটি ঠিক কোথায় আছেন এটি চিহ্নিত করা সম্ভব হবে। আবার এ প্রযুক্তির সাথে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সমন্বয় করে ব্যক্তির জিও লোকেশন ছাড়াও এক সঙ্গে বহু মানুষের গতিবিধি বা মুভমেন্ট সম্পর্কেও জানতে পারবে নজরদারিতে জড়িত সংস্থাগুলো।

এজন্য মোবাইল অপারেটরদের নিজ খরচে নতুন সফটওয়্যার ও প্রয়োজনীয় উপকরণ সংযোজন করতে চাপ দেয়া হলেও বিটিআরসি কিংবা সরকারের ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের এ বিষয়ে কোন সম্পৃক্ততা নেই বলে জানিয়ে ওই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার বলেন, বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর বিষয়। বিদ্যমান আইন অনুযায়ী দেশ ও জনগণের স্বার্থে যা করা যায় সেটাই তারা করে থাকে। আমাদের এ বিষয়ে কিছু জানা নেই।

তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা ও সংসদ নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে এবং নাগরিক অধিকার পরিস্থিতির আলোকে নতুন এই প্রযুক্তি নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে অনেকের মধ্যে। কারণ অনেকের আশঙ্কা এটি নির্বাচনের আগে বিরোধীদের দমনের ‘ব্যাপক ভিত্তিক নজরদারি বা আড়িপাতায়’ অপব্যবহার হতে পারে।

তথ্যযোগাযোগ প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাষ্ট্রের নিরাপত্তার কথা বলে গণ-নজরদারির একটি সুযোগ তৈরি হতে যাচ্ছে বাংলাদেশে এবং তাদের আশঙ্কা এটি বিরোধী মত দমনে অপব্যবহারের আশঙ্কা রয়েছে।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ আইন অনুযায়ী টেলিকম অপারেটররা সরকারি সংস্থার চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে বাধ্য। যদিও অপারেটররা এসব বিষয়ে কোন মন্তব্যই করতে রাজী হয়নি।

নতুন প্রযুক্তি আসলে কী
নতুন এই প্রযুক্তির আনুষ্ঠানিক নাম ইন্টিগ্রেটেড ল’ফুল ইন্টারসেপশন সিস্টেম। মূলত আড়িপাতা বা নজরদারির জন্য এটি একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা, যাতে ব্যক্তির অবস্থান চিহ্নিত করতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সাথে জড়িত থাকবে টেলিকম সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোও।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান জানিয়েছিলেন, সরকার একটি ইন্টিগ্রেটেড ল’ফুল ইন্টারসেপশন সিস্টেম বা সমন্বিত আইনসম্মত আড়িপাতা পদ্ধতি চালু করতে যাচ্ছে। ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মনিটরিংয়ের মাধ্যমে দেশ ও সরকার বিরোধী কার্যক্রম বন্ধে এনটিএমসিতে (ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার) ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স টেকনোলজির (ওএসআইএনটি) মতো আধুনিক প্রযুক্তি সংযোজিত হয়েছে। একই সঙ্গে একটি ইন্টিগ্রেটেড ল’ফুল ইন্টারসেপশন সিস্টেম চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

এটিই শেষ পর্যন্ত আগামী মাস থেকে চালু করা হচ্ছে বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে। বিশেষ করে টেলিকম অপারেটরদের এজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা দিয়েছে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এছাড়াও নতুন এ ব্যবস্থা চালু করতে সরকারি সংস্থার জন্য এ সংক্রান্ত উপকরণও ফ্রান্সের একটি কোম্পানি থেকে ক্রয় করা হয়েছে। এর বাইরে মোবাইল অপারেটরদের সফটওয়্যার ও বিভিন্ন উপকরণ কিনতে ব্যয় করতে হচ্ছে আরো প্রায় দুশো কোটি টাকা।

কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এ প্রযুক্তির মাধ্যমে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো প্রয়োজন অনুযায়ী জিও লোকেশন (ব্যক্তির সুনির্দিষ্ট অবস্থান)সহ দরকারি সুবিধা নিতে পারবে। তবে সরকারি কিছু নথিপত্র বলছে এ সংক্রান্ত প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিলো ২০১৬ সালে। পরে ২০১৮ সালে সরকারি একটি চিঠিতে বলা হয়েছিলো নতুন এ প্রযুক্তি অপরাধ দমনে ব্যবহার করা হবে। এর ধারাবাহিকতায় গত বছর জুনে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত কমিটি এ সংক্রান্ত ক্রয় প্রস্তাবে অনুমোদন দিয়েছিলো। তখন বলা হয়েছিলো যে ফ্রান্সের একটি কোম্পানি থেকে ১৭২ কোটি টাকা ব্যয়ে এগুলো কেনা হবে।

নতুন নজরদারি প্রযুক্তি কীভাবে কাজ করবে
সরকারি একটি চিঠি থেকে জানা যাচ্ছে নজরদারির এ ব্যবস্থায় মোবাইল অপারেটররা ছাড়াও ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান (আইএসপি), ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) প্রতিষ্ঠান এবং ন্যাশনাল ইন্টারনেট এক্সচেঞ্জ (এনআইএক্স) এর মতো সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি সংস্থার সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে।

আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলো অবশ্য টেলিকম অপারেটরদের কাছ থেকেই তাদের গ্রাহকদের জিও লোকেশন বা সুনির্দিষ্ট ব্যক্তি অবস্থান সম্পর্কিত তথ্য পাবে। আবার সরকারি সংস্থা চাইলে সরাসরি অপারেটরদের ডাটাবেজে ঢুকেও কোন ব্যক্তির বিষয়ে নজরদারি করতে সক্ষম হবে।

প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির অবশ্য বলছেন, নজরদারির এই প্রযুক্তি বাংলাদেশে নতুন হলেও বিশ্বে অনেক পুরনো। একজন গ্রাহকের মোবাইল ফোনটি একই সাথে ২/৩ বা আরও বেশি কাছাকাছি টাওয়ার থেকে সিগন্যাল পায় এবং এর মধ্যে যেটি সবচেয়ে শক্তিশালী তার মাধ্যমেই সে অন্যের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়। এখানে ‘একটি ট্রায়াংগুলেশন মেথড’ ব্যবহার করে বিভিন্ন উপকরণের সহায়তায় ওই মোবাইল ফোনটির সুনির্দিষ্ট অবস্থান চিহ্নিত করা হবে। সফটওয়্যার মোবাইল অপারেটরের সেন্ট্রাল কন্ট্রোল রুমে থাকবে। সেখানে তারা জানবে ঠিক কোথায় আছে মোবাইল ফোনটি। সংশ্লিষ্ট ফোন অপারেটর সেই তথ্য সরকারি সংস্থাকে জানাবে। আবার সরকারি সংস্থা নিজেও কানেক্টেড থাকবে সিস্টেমে এবং এর মাধ্যমে তারা নিজেরাও টেলিকম অপারেটরের কন্ট্রোল পার্টের এক্সেস নিয়ে সুনির্দিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের ফোনের অবস্থান সম্পর্কে জানতে পারবে। মূলত প্রত্যেকটি ফোনের আইএমইআই নাম্বার আছে, যেটি ইউনিক নাম্বার। সেই নাম্বারকেই নজরদারির এই সিস্টেমে কানেক্ট করিয়ে দেয়া যাবে এবং একটি মোবাইলে যে কয়টি সিম থাকবে সব কয়টিকেই এক সাথে ট্র্যাক করা যাবে।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে মোবাইল সেট রেজিস্ট্রার পদ্ধতি চালু আছে। ফলে প্রতিটি ফোনের আইএমআই নাম্বার কর্তৃপক্ষের কাছে আছে। বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলে এ প্রযুক্তি কীভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে যে ধারণা পাওয়া গেছে তাহলো – ধরুন একজন ব্যক্তি কারওয়ানবাজারে অবস্থান করছে। এখন কোন সংস্থাগুলো চাইলে সংশ্লিষ্ট অপারেটর বলতে পারে যে তিনি জনতা টাওয়ার ও সোনারগাঁও হোটেলের মধ্যবর্তী কোন জায়গায় আছেন। কিন্তু নতুন ব্যবস্থা চালুর পর ওই মধ্যবর্তী জায়গার মধ্যে ঠিক কোন জায়গায় তিনি অবস্থান করছেন সেটিও জানা সম্ভব হবে।

আলোচনা বা উদ্বেগের কারণ কী
বিশেষজ্ঞরা বলছেন উদ্বেগের কারণ হলো– অপব্যবহারের আশঙ্কা। বিশেষ করে সামনে নির্বাচন ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এটি বিরোধীদের ওপর দমন পীড়নে ব্যবহারের সুযোগ তৈরি হতে পারে। কারণ কোন সংস্থা যদি মনে করে তারা বিশ হাজার ফোন নাম্বরের অবস্থান ও গতিবিধি সম্পর্কে একসাথে জানতে চায়। সেটি এই পদ্ধতিতে সম্ভব হবে। ওই বিশ হাজার নম্বরবাহী ফোন কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছে সেটিও শনাক্ত করা সম্ভব হবে নতুন ব্যবস্থার মাধ্যমে। ফলে কেউ যদি মনে করে সারাদেশ থেকে তার নেতাকর্মী ও সমর্থকদের ঢাকায় এনে প্রতিবাদ করবে তাহলে নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে সহজেই জানা সম্ভব হবে কারা কীভাবে ঢাকায় আসছে এবং তারা ঠিক কে কোথায় আছে।

মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি অব মালয়ার আইন ও উদীয়মান প্রযুক্তি বিভাগের শিক্ষক মুহাম্মদ এরশাদুল করিম বলছেন, উদ্বেগের জায়গাটা এখানেই। ধরুন দশ লাখ লোক ঢাকার বাইরে গেলো কিংবা বাইরে থেকে ঢাকায় আসবে- তাদের প্রত্যেকের স্পেসিফিক অবস্থান চিহ্নিত করা সম্ভব হবে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে আদালতের অনুমতি নিয়ে কারও ওপর নজরদারি করা যায়। কিন্তু এমন গণহারে নজরদারি আপত্তিকর ও মানবাধিকার লঙ্ঘন।

প্রসঙ্গত, বিশ্বের উন্নত অনেক দেশে জরুরি সেবার সাথে জড়িত সংস্থাগুলো এ ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করে। তবে তাদেরকেও ব্যক্তির নাম পরিচয় দেয়া হয় না বলে তারা সেটি নজরদারিতে ব্যবহার করতে পারে না।

সুমন আহমেদ সাবির বলছেন, প্রযুক্তিটি অপরাধীকে ধরা বা দুর্ঘটনা প্রতিরোধে ভালোভাবে ব্যবহার সম্ভব। কিন্তু কেউ যদি মুক্ত চিন্তা বা নাগরিক অধিকারকে সংকুচিত করতে চান তাহলে এর মারাত্মক অপব্যবহার হতে পারে।

আড়িপাতা নতুন নয়
বাংলাদেশে বহু বছর ধরেই মোবাইল ফোন ও সামাজিক মাধ্যমে নজরদারি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মধ্যকার ফোনালাপসহ গত এক দশকে অনেকগুলো মোবাইলের কথোপকথন ফাঁস হওয়ার উদাহরণও রয়েছে। রাজনৈতিক ও অ্যাকটিভিস্টরা বলছেন, এভাবে আড়িপাতার কারণে তাদের মধ্যে উদ্বেগ এবং বাড়তি চাপ তৈরি করছে।

এমনকি গত বছর ইসরায়েলের সংবাদপত্র হারেৎজ-এ এমন তথ্যও এসেছিলো যে বাংলাদেশের কাছে ইসরায়েলি গোয়েন্দা নজরদারি প্রযুক্তি বিক্রি করা হয়েছে। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে, আধা কিলোমিটার পরিধিতে থাকা সব ডিভাইসে হোয়াটসঅ্যাপের এনক্রিপ্টেড বার্তা, ফেসবুকের চ্যাট, কন্টাক্ট লিস্ট, কল এবং বার্তায় প্রবেশ করা যায়। এর আগে ২০২১ সালে, কাতারভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম আল-জাজিরায় এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে ইসরায়েল থেকে একই ধরনের নজরদারী প্রযুক্তি কেনার বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়। ভয়েস অব আমেরিকাকে ২০২১ সালের অগাস্টে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে এনটিএমসির প্রধান, মেজর জেনারেল (তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল) জিয়াউল আহসান বলেছিলেন, তার প্রতিষ্ঠান দেশের স্বার্থে সরকারের চাহিদা অনুযায়ী সহায়তা করছে বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে। এই এনটিএমসি-এর তত্ত্বাবধানেই এখন ইন্টিগ্রেটেড ল’ফুল ইন্টারসেপশন সিস্টেম চালু হচ্ছে বলে এ সংক্রান্ত সরকারি নথিগুলো বলছে।