| |
               

মূল পাতা আরো সম্পাদকীয় ঐক্যের পথ ও প্রক্রিয়া; অনেক হয়েছে, এবার একটু ভাবুন


ঐক্যের পথ ও প্রক্রিয়া; অনেক হয়েছে, এবার একটু ভাবুন


মুফতি এনায়েতুল্লাহ     21 May, 2022     10:43 PM    


প্রায় সবাই জানেন, মানেন এবং স্বীকার করেন, আলেম-উলামা ও ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য একটি অনিবার্য বিষয়। তার পরও তারা সবেচেয়ে বেশি কোন্দল-ভাঙনে জর্জরিত। মজার বিষয় হলো, আগে হাজার মানুষের নেতা কোন্দলে জড়িয়ে, স্বার্থের টানে বিলীন হতে হতে এখন হয়েছেন পারিবারিক নেতা। তবুও আত্মতুষ্টিতে মজে আছেন, নেতামি টিকে আছে বলে। মুসলমান তথা আলেম-উলামাদের দলবদ্ধ না থাকার হাজারটা ক্ষতির কারণ এই নেতা বলতে পারবেন, তার পরও তিনি কিংবা তারা ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করবেন না। আখেরে চেয়ার চলে যাওয়ার ভয়ে। এখানে নীতি-আদর্শ অনেকটাই গৌণ। যদিও নেতারা এর দাবিদার, কিন্তু কর্মকান্ডে এর কোনো প্রভাব দেখা যায় না।

চিন্তার মতপার্থক্যগত কারণে ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু হওয়া বিপর্যয় এখনও চলমান। ফলে ইতিহাসের পাতা থেকে, জাতীয় রাজনীতির ময়দান থেকে, নতুন প্রজন্মের দেমাগ থেকে বিস্মৃত হওয়ার পথে আলেমসমাজ ও ইসলামি রাজনীতিকরা। চিরন্তন সত্য কথা হলো, নেতিবাচক সময়ে (বৃটিশ শাসনামলে) ইতিবাচক ঐক্য (স্বাধীনতার লড়াই) ছিল। অনৈক্যের কারণে আবার বিপর্যয় ঘটে অর্থাৎ ভারত-পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম। যে রাষ্ট্র ইসলামের জয়গানে (পাকিস্তান) ছিল মুখর, তা আবার বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। অর্থাৎ স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। তারপরও কি আমার ঐক্যবদ্ধভাবে পথ চলতে পেরেছি। সোজা উত্তর- না।

অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, মানুষের কাছে সম্মানীয় কিন্তু পরস্পরবিরোধী আলেম রাজনীতিকরা শক্তি ক্ষয় করতে করতে এখন বিলীন হওয়ার পথে। তীব্র দ্বন্দ্ব, মানসিক সংঘাত, স্বার্থের চিন্তাজনিত অনৈক্য, স্বজনতোষণ, পরিবার প্রথা বাংলাদেশের আলেম সমাজকে আচ্ছন্ন করে আছে। এটা সবাই বুঝলেও, আমি পাঁচজনের নেতা, তাতেই সন্তুষ্ট। আমার আর কিচ্ছু চাই না- এমন মানসিকতার অনলে পুড়ছে তারা। এ কারণে যদিও সবাই আলাদা আলাদাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, তবুও নিজ বলয় ত্যাগ না করতে পারার গোড়ামী মাথা থেকে নামেনি। সামনেও নামবে বলে মনে হয় না।

সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশে ইসলামি শক্তির উৎস আলেমসমাজ ও ইসলামি রাজনীতিকরা আজ খণ্ড-বিখণ্ডতার প্রতীক। ঐতিহ্যতো আগেই গেছে, এখন অস্তিত্ব হারানোর পথে। বাংলাদেশের মুসলমানরা মোটাদাগে ধার্মিক। তারা ইসলাম সম্পর্কে বেশি না জানলেও নামাজ-রোজা নিয়মিত করে, আলেম-উলামাদের সম্মান করে; ধর্মীয় বিষয়ে কোনো আঘাত এলে তারা প্রতিবাদ করে, রাস্তায় নেমে আসে। তারা একক কোনো দল বা ঘরানার নয়। এর বিপরীতে স্পষ্টভাবে ইসলামপন্থী ও ধর্মনিরপেক্ষতাপন্থী রয়েছে। সংখ্যায় ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা লঘিষ্ঠ, কিন্তু প্রভাবে গরিষ্ঠ। পক্ষান্তরে ইসলামপন্থীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও প্রভাবে লঘিষ্ঠ। ২০০০ সাল থেকে এই ইসলামপন্থীদের মধ্যে অনেক শাখা-প্রশাখা গজিয়েছে, গয়রহ ভাঙনের শিকার হয়েছে ইসলামি দল, সংগঠনগুলো। ভাঙনের মুহূর্তে একপক্ষ অপরপক্ষকে সরকারি আনুকূল্য লাভের দোষে দোষারোপ করে, উভয়পক্ষ নিজেকে নীতির প্রতি অটল, সাংগঠনিক কাঠামো রক্ষার অতন্দ্রপ্রহরী দাবি করলেও পরবর্তীতে মাঠে-ময়দানে এর কোনো প্রভাব দেখা যায়নি। এভাবে বিগত ২১ বছরে দিন দিন দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়েছে ইসলামি শক্তিগুলো। কেউ আত্মসমীক্ষা, উম্মাহর জন্য আন্তরিক দরদ নিয়ে কাজ করছে বলে প্রতীয়মান না হওয়ায় আজও ভাঙন, পরস্পর বিরোধীতা চলমান।

বাংলাদেশের ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোকে তিন ভাগে করা যায়। প্রথমাংশ যারা সত্যিকার অর্থে দীনকে কায়েম করতে চায়। মত ও পথের ভিন্নতা সত্যেও এদের প্রতি সচেতন নাগরিকের সমর্থন রয়েছে। দ্বিতীয় অংশ ইসলামি সমাজ ব্যবস্থা কিংবা শরিয়ত বোঝে না। সাধারণভাবে গরিষ্ঠ মুসমানদের এরা সরল সমর্থন জ্ঞাপন করে। ‘ইসলামি মূল্যবোধে তারা সীমাবদ্ধ।’ ইসলামি কিছু শব্দ উচ্চারণ ও আনুষ্ঠানিকতায় তারা বিশ্বস্ত। আরেকটি অংশকে বলা যায় ইসলামি পরিভাষায়, ‘ওলামায়ে ছু।’

শেষোক্ত শ্রেণির লোকেরা শাসক দলের তাঁবেদার হিসেবে কাজ করে। তাদের কাজ হচ্ছে দলের কিংবা সরকারের অন্যায় ও অসত্যকে ইসলামি লেবাস পরানো। আইয়ুব খানের শাসনামলে থেকে শুরু করে বঙ্গবন্ধু, জিয়াউর রহমান, এরশাদ, খালেদা জিয়া ও হাসিনাসহ সব সরকারের আমলে তারা ভোল পাল্টে ক্ষমতার কাছাকাছি থেকেছে। পীর, খানকা, মাদ্রাসা, বড় কোনো ব্যক্তিনির্ভর এই শ্রেণির লোকেরা বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, পেশাজীবী সংগঠনের নামের পাশাপাশি সরাসরি বিভিন্ন নাম নিয়ে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেছে। তারা কোনো কল্যাণমূলক কাজ করুক বা না করুক তাদের দিয়ে অন্য দলে ভাঙন ধরানো, মানুষের সরল বিশ্বাসে আঘাত, রাজনীতির ময়দানে বিভ্রান্তি ছড়ানোর কাজটি হয়েছে ও হচ্ছে চমৎকারভাবে। তারা নিজেদের বাদের অন্য সব অংশের ইসলামি রাজনীতির অংশকে বিভ্রান্ত মনে করে। নানা রকম ফতোয়া দিয়ে বেড়ায়। ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন করে অনভিজ্ঞতার কারণে ফলাফল নিজেদের ঘরে তুলতে পারে না। তবুও তারা রাজনীতির সঙ্গে ওপপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত। তাদের কাজই হলো, অন্যের হয়ে ছাতা ধরে কোনো না কোনো গোষ্ঠী, দল কিংবা ব্যক্তির বিরোধীতা। ভিন্ন ব্যাখ্যা ও চিন্তা দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা। কমবেশি তাদের যে জনসমর্থন নেই, সেটা বলা যাবে না। এমন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকেন্দ্রিক রাজনৈতিক দলে গঠন, লক্ষ, কর্মপদ্ধতিতে নানা ধরনের সন্দেহ আছে, প্রশ্ন আছে, তাদের পেছনে আবার কেউ কেউ সরকারের ষড়যন্ত্রের আভাস পান। এমন রাজনৈতিক অপতৎপরতা আজকের আলোচ্য বিষয় নয়। তাই আর সেদিকে যাচ্ছি না।

মূল পয়েন্ট, আলেমসমাজ ও ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলো এখন একটি কঠিন সময় অতিক্রম করছে, এমতাবস্থায় সুবিধাবাদী, বঞ্চিত, পকেট দল ও সম্ভাবনাময় শক্তি কারও সুখে থাকার কথা নয়। কেউ আছেন সরকারের নিপীড়ন-নির্যাতনের মুখে, অন্যরা জনসমর্থন হারিয়ে মাঠে বের হতে পারছেন না- লজ্জায়। এই সুযোগে ইসলামি রাজনীতি ও আলেম-উলামাদের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্র হচ্ছে। কেউ করছেন তালিকা, কেউ সবক দিচ্ছেন সংস্কারের, কেউ সুবিধা দিয়ে বগলতলে দাবিয়ে রাখছেন- এভাবে বিপক্ষ শক্তিরা আলেমদের ব্যাসার্ধ মাপার কাজটি সুন্দরভাবে করে নিচ্ছেন।

রাজনীতিতে ক্ষমতাসীনদের রোষানল, ভয়-ভীতি নতুন কিছু নয়। এটা যদি আপনি জয় করতে না পারেন, আপনার রাজনীতিতে আসার দরকার নেই। যেহেতু রাজনীতিতে জড়িয়েছেন সুতরাং মানুষের বিশ্বাস ও আবেগ নিয়ে ছিনিমিন খেলার অধিকার আপনার নেই। মানছি, বাংলাদেশের আলেমসমাজ ও ইসলামি জনতা একটি জটিল ও কূটিল পথ অতিক্রম করছে। সকলেই বোঝে যে, আলেম সমাজে অবিচ্ছেদ্য ও সুদৃঢ় ঐক্যই কেবল তাদের অব্যাহত নিপীড়ন থেকে রক্ষা করতে পারে। দীনের পথে এগিয়ে দিতে পারে। অথচ সেই অনিবার্য ঐক্য অর্জিত হচ্ছে না। তাই এটি চিন্তা করা, আলোচনা করা, গবেষণা করা খুবই জরুরি। কীভাবে, কী পথে ইসলামি ঐক্য অর্জিত হতে পারে।

এক্ষেত্রে সব দলের চিন্তাকে সমুন্নত করার জন্য একটি ঘরোয়া আলোচনা সভার আয়োজন করা যেতে পারে। দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেম বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিকরা তাতে অংশগ্রহণ করবেন। প্রয়োজনে দুই-তিনবার বসে কৌশল নির্ণয় করা যায়। বর্তমান অবস্থার কঠোরতা ও দুর্ভেদ্যতা সবাই বোঝেন। হতাশ হওয়ার কিছু নেই। যত মুশকিল, তত আসান। পরিস্থিতি যত কঠিনই হোক, আল্লাহ ইচ্ছা করলে পথ সহজ করে দিতে পারেন। প্রথমত এক বা একাধিক অরাজনৈতিক ব্যক্তির সকল ইসলামি নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলা। প্রয়োজনে সবদলের সমন্বয়ে ছোট কমিটি করা। ওই কমিটির ব্যক্তিবর্গ হবেন সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও সচল। সুবিধাবাদী, অতিরাজনৈতিক ও গোলআলু মার্কা কাউকে রাখার দরকার নেই। আবার এই কমিটিতে সবাইকে রাখতে হবে, এটাও জরুরি না। এই কমিটি সকল ইসলামি দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলে কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করবে, ঐক্যের পথের অন্তরায়গুলো চিহ্নিত করবে। ভবিষ্যতে পথচলার লক্ষ্যে এক প্ল্যাটফর্মে আসা যায় কি না, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে। এভাবে বৈরিতা, ভিন্নতা ও বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য সূচিত হতে পারে। তবে পুরো প্রকিয়ায় অবশ্যই বিশ্বাসঘাতক এবং সুবিধাবাদীদের সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে।